যেভাবে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন
আপনি যদি অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের কথা ভেবে থাকেন তাহলে প্রথমেই আপনাকে
জানতে হবে কাদের জন্য আয়কর রিটার্ন প্রযোজ্য। আরো জানতে হবে আয়কর রিটার্ন দাখিল
করার জন্য যেসব কাগজপত্র লাগবে।
আজকের এই কনটেন্টে আমরা বিস্তারিতভাবে জানবো যেভাবে আপনারা অনলাইনে রিটার্ন
দাখিল করবেন। এর সঙ্গে রিটার্ন দাখিলের বিস্তারিত পদ্ধতি এবং গত পাঁচ বছরে
বাংলাদেশে আয়কর রিটার্ন দাখিলের পরিসংখ্যান ও জানবো।
পোস্ট সুচিঃ (যে বিষয়টি পড়তে চান সেখানে ক্লিক করুন)
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে আয়কর রিটার্ন দাখিলের পরিসংখ্যান
বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে আয়কর রিটার্ন দাখিলের পরিসংখ্যান ক্রমবর্ধমান ভাবেই
বৃদ্ধি পেয়েছে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের একটি ছক নিচে প্রদান করা হলো।
সাল | রিটার্ন দাখিলের পরিমান (লাখে) | বিবরণ |
---|---|---|
2018-19 | 20 | কিছু উন্নতি |
2019-20 | 22 | স্থিতিশীলতা |
2020-21 | 25 | কোভিড পরিস্থিতির পরেও আংশিক বৃদ্ধি |
2021-22 | 29 | নতুন করনীতি ও প্রচারণার ফলে বৃদ্ধি |
2022-23 | 36 | বাধ্যতামূলক রিটার্ন দাখিলের কারনে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি |
২০২২-২৩ অর্থবছরে বাধ্যতামূলকভাবে ”প্রুফ অফ সাবমিশন অফ ট্যাক্স রিটার্ন”
(PSR) চালুর কারণে রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে
প্রায় ৯৪ লাখ নিবন্ধিত করদাতা থাকলেও রিটার্নের সংখ্যা ৩৬ লাখের কাছাকাছি,
যা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম।
এই সংখ্যা সরকারি উদ্যোগ ও জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে আগামী বছরে আরো
উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। এর সঙ্গে অনলাইন রিটার্ন দাখিল এর ব্যবস্থা চালু
হওয়ায় রিটার্ন প্রদান করার সংখ্যা আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা
যায়।
আয়কর যাদের জন্য প্রযোজ্য
আয়কর কারা দেবে? এই প্রশ্নের জবাব এনবিআর দিয়ে দিয়েছে। তাদের নিয়ম
অনুযায়ী কোন ব্যক্তির বার্ষিক আয় ৩ লাখ ৫০ হাজারের বেশি হলেই তাকে আয়কর
দিতে হবে। তবে যেসব নাগরিকদের বয়স ৬৫ বা তার বেশি এবং নারীদের ক্ষেত্রে
আয়ের সীমা ৪ লাখ টাকা। এবং যেসব মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধাহত তাদের জন্য এটি পাঁচ
লাখ টাকা।
এছাড়াও পরবর্তী বছরের গড় মূল্যায়ন, শহরে বাসস্থান, গাড়ির মালিকানা,
নির্দিষ্ট কিছু পেশার সদস্যপদ, ব্যবসায়িক অবস্থা, দরপত্র বা নির্বাচনেও
অংশগ্রহণের জন্য আয়কর পরিশোধ করতে হয়। আয়কর বাংলাদেশে নিবন্ধিত যে কোন
কোম্পানি ও এনজিও গুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
এছাড়াও কারো যদি টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) থেকে থাকে তাহলে তাকেও
রিটার্ন দাখিল করতে হবে যদিও তার করযোগ্য আয় থাকুক বা না থাকুক। করযোগ্য আয়
না থাকলে শূন্য রিটার্ন দাখিল করতে হবে। শূন্য রিটার্ন দাখিল না করলে আইনে
শাস্তি ও জরিমানার বিধান রয়েছে।
রিটার্ন দাখিলের জন্য যেসব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র লাগবে
কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কে কর দিতে হলে নিম্নলিখিত প্রয়োজনীয়
কাগজপত্রগুলি দাখিল করতে হবেঃ
- ইটিআইএন
- জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি
- বিস্তারিত ঠিকানা
- আগের বছরের রিটার্নের নথি
- একাধিক আয়ের উৎসের কাগজপত্র
- বিনিয়োগের বিবরণ
- ব্যাংক স্টেটমেন্ট
- সকল সম্পত্তির তথ্য
- করমুক্ত আয়ের সার্টিফিকেট
যেভাবে রিটার্ন দাখিল করবেন
বাংলাদেশে যেসব ব্যক্তির বয়স ১৮ অতিক্রম করেছে তাদের সকলকেই টিআইএন সনদ
নিতে হবে। কেউ যখন টিআইএন এর জন্য আবেদন করবে, তখন করদাখিলের জন্য একটি
নির্দিষ্ট এলাকা বরাদ্দ করা হবে।
টিআইএন সনদ যাহারা গ্রহণ করেছেন তাদের প্রত্যেককেই প্রতিবছর আয়কর রিটার্ন
দাখিল করতে হবে। কারো যদি আয় না থাকে তাহলে তাকেও রিটার্ন দাখিল করতে
হবে।
রিটার্ন দাখিল এর সময় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে রিটার্ন জমা দিতে হবে।
এরপর নিজে উপস্থিত থেকে বা কোন প্রতিনিধির মাধ্যমে বা অনলাইনে সংশ্লিষ্ট
আঞ্চলিক কর অফিসে যোগাযোগ করে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে।
অনলাইনে রিটার্ন দেয়ার পদ্ধতি
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হলে আপনাকে ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি ধাপ
অতিক্রম করতে হবেঃ
- ধাপ একঃ প্রথমেই আপনাকে এনবিআর এর ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে হবে। সেখানে প্রবেশের পর সাইন আপ অপশনে গিয়ে প্রথম বক্সে আপনার টিআইএন নাম্বার লিখুন। দ্বিতীয় বক্সে আপনার জাতীয় পরিচয় পত্র থাকা নিবন্ধিত মোবাইল নাম্বারটি লিখুন। মোবাইল নাম্বার লিখার সময় সামনের শুন্যটি বাদ দিবেন। এরপর ক্যাপচা কোড দিয়ে ভেরিফাই বাটনে ক্লিক করুন। ভেরিফাই বাটনে ক্লিক করলে আপনার মোবাইল নাম্বারে একটি ওটিপি আসবে। ওটিপিটি সাবমিট করার মাধ্যমে আপনার মোবাইল নাম্বারটি নিশ্চিত করুন। এবং ইরিটার্ন সিস্টেমে লগইন করতে একটি পাসওয়ার্ড ঠিক করুন। পাসওয়ার্ডটি মনে রাখুন অথবা কোথাও লিখে রাখুন যেন লগইন করার সময় ভুল না হয়।
- ধাপ দুইঃ আপনার নিবন্ধন শেষ হয়ে গেলে আপনি আবারও আপনার টিআইএন নম্বর, পাসওয়ার্ড এবং ক্যাপচা দিয়ে সাইন ইন করুন। সাইন ইন করলে একটি ড্যাশবোর্ড পাবেন। ড্যাশবোর্ডের বাম দিকে থাকা রিটার্ন সাবমিশন অপশন এ ক্লিক করুন।
- ধাপ তিনঃ আপনার রিটার্ন ফরমের শুরুতেই ট্যাক্স অ্যাসেসমেন্ট ইনফর্মেশন পাবেন। সেখানে আয়কর সংক্রান্ত সকল তথ্য, উৎস, সাল, আয় এর পরিমাণ প্রদান করতে হবে। আপনার আয় যদি করমুক্ত হয় তাহলে আপনাকে ’রেসিডেন্ট স্ট্যাটাস’ ক্লিক করতে হবে।
- ধাপ চারঃ এরপরে আপনার বিভিন্ন আয়ের উৎস গুলো ’হেডস অফ ইনকামে’ প্রদান করুন। আপনার বেতন, সুদ, বাড়িভাড়া, সম্পত্তি থেকে আয়, কৃষি থেকে আয়, ব্যবসা থেকে আয়, মূলধন, এফডিআর, সঞ্চয়পত্র বা অন্যান্য উৎস থেকে আয় থাকলে তা অন্তর্ভুক্ত করুন। যদি এমন হয় যে আপনি শুধুমাত্র বেতন গ্রহণ করেন এবং আপনার অন্য কোন আয় নেই তাহলে স্যালারি অপশনে ক্লিক করুন। এর বাইরে আয় থাকলে ’ইনকাম ফ্রম আদার সোর্সেস’ অপশনে ক্লিক করুন। এছাড়া অন্যান্য উৎস থাকলে সেগুলোতেও ক্লিক করুন। এরপর সেভ এন্ড কন্টিনিউ বাটনে ক্লিক করে পরবর্তী ধাপে চলে যান।
- ধাপ পাঁচঃ এই ধাপে ড্রপডাউন মেনু থেকে প্রাথমিক আয়ের উৎস ঠিক করে দিন। আপনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী বা আইনি অভিভাবক হয়ে থাকলে সেটিও অন্তর্ভুক্ত করুন এছাড়াও বিনিয়োগের জন্য করমুক্তির দাবিদার কিনা বা সেয়ার হোল্ডার কিনা বা পরিচালক কিনা, তা হা/না এর মাধ্যমে উত্তর দিন।
- ধাপ ছয়ঃ আপনি এই পাতায় আইটি ১০ বি ফরম নামে একটি অপশন পাবেন। আপনার আয় বা আপনার সম্পদের পরিমাণ যদি ৪০ লাখ টাকার বেশি হয় তাহলে এই বিভাগটি পূরণ করতে হবে। আর আয় যদি ৪০ লাখের নিচে হয় সেক্ষেত্রে এটি পূরণ করতে হবে না। তবে এক্ষেত্রে আপনার ও আপনার পরিবারের বার্ষিক খরচের হিসেব দিতে হবে। এরপরে সেভ এন্ড কন্টিনিউ বাটনে ক্লিক করে পরবর্তী ধাপে যেতে হবে।
- ধাপ সাতঃ এই ধাপে অন্যান্য উৎস থেকে আয়, বৈদেশিক আয় বা কর অব্যাহতি প্রাপ্ত আয়ের বিবরণ দিন। বেতন বা করযোগ্য বিনিয়োগ ছাড়াও অন্যান্য আয়ের বিবরণ দিতে হলে ড্রপডাউন মেনুতে বিভিন্ন অপশন পেয়ে যাবেন। সেগুলো সিলেক্ট করুন।এনি আদার ইনকাম অপশন এ ক্লিক করলে সেখানে আপনার অন্য আয়ের উৎস, অর্থ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ, প্রাপ্ত আয়ের তারিখ ও পরিমান এবং ব্যয়ের হিসাব দিতে হবে। এসব তথ্য প্রদান করার পর আপনাকে আপনার নেট আয় এর হিসেব দেখানো হবে। হিসেবটি পাওয়ার পর সেভ এন্ড কন্টিনিউ বাটনে ক্লিক করে পরবর্তী ধাপে এগিয়ে যান।
- ধাপ আটঃ আপনি যদি কোথাও বিনিয়োগ করে থাকেন যেমন জীবন বিমা প্রিমিয়াম, ডিপোজিট প্রিমিয়াম বা ডিপিএস, সঞ্চয়পত্র, প্রভিডেন্ট ফান্ড, বেনি ভোলেন্ট ফান্ড, গ্রুপ বীমা ফান্ড, স্টক বা শেয়ার ফান্ড বা অন্য কোন ক্যাটাগরির কোন বিনিয়োগ করে থাকেন তবে তা এখানে উল্লেখ করতে হবে। ধরুন আপনি ডিপিএস অপশনে ক্লিক করলেন, তাহলে সেখানে ব্যাংকের নাম, অ্যাকাউন্ট নাম্বার এবং জমাকৃত অর্থের পরিমাণ দিতে হবে। এভাবে প্রতিটি অপশনে গিয়ে বিস্তারিত তথ্য দিতে হবে। এরপরে সেভ এন্ড কন্টিনিউ বাটনে ক্লিক করে পরবর্তী ধাপে যেতে হবে।
- ধাপ নয়ঃ এই ধাপে আপনার আয়ের বিপরীতে আপনাকে মোট ব্যয় পর্যালোচনা করতে। এখানে বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন ব্যয়ের বিভাগ থাকবে। যেমন খাদ্য, পোশাক, বাসস্থান, যাতায়াত, গৃহস্থালি, বিভিন্ন ধরনের বিল, বাচ্চাদের শিক্ষা প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। এই বিবরণ গুলো পূরণ করার পরে আপনাকে বকেয়া করের হিসেব দেওয়া হবে।
- ধাপ দশঃ এই ধাপে আপনি এর আগে কোন কর দিয়ে থাকলে বা অগ্রিম কর প্রদান করে থাকলে তার হিসেব দিতে পারবেন। এই হিসেব দেয়ার পরপরই আপনার মোট প্রদেয় করের পরিমাণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে যাবে। আপনার আয়ের উপর কোন কর বকেয়া না থাকলে আপনার করের পরিমাণ হবে শূন্য।
- ধাপ এগারোঃ আপনার রিটার্ন ফর্মটি দেখতে চাইলে অনলাইন রিটার্ন অপশনে ক্লিক করতে হবে। তার নিচে ইয়েস অপশনে ক্লিক করলেই আপনার রিটার্ন চলে আসবে। কোন তথ্য নিয়ে সমস্যা মনে হলে আপনি নো অপশনে ক্লিক করতে পারেন এবং আপনার তথ্যগুলো দেখে নিতে পারেন।
- ধাপ বারোঃ এই ধাপে আপনার সবকিছু ঠিক থাকলে আপনাকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি রেফারেন্স আইডি প্রদান করা হবে। সেই রেফারেন্স আইডি দিয়ে আপনি অনলাইনে বা ব্যাংকে গিয়ে টাকা প্রদান করতে পারেন এবং আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারেন। রিটার্ন দাখিল হলে সেটি প্রিন্ট করে সকল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহ আয়কর অফিসে গিয়ে জমা দিতে হবে।
আপনার কাছে এই সমস্ত প্রক্রিয়াটা জটিল মনে হলে এবং যেসব ক্ষেত্রে সরকার
অনলাইনে রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক করেছেন সেসব ক্ষেত্রে যদি আপনি না পড়ে
থাকেন তাহলে আপনি কোন আয়কর আইনজীবির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন অথবা বিডি
ট্যাক্স বা শাপলা ট্যাক্স বা এরকম আরো অনেক অনলাইন প্লাটফর্ম আছে যারা আপনাকে
আয়কর রিটার্ন দাখিলে সহায়তা করতে পারবে।
স্বপ্নকথার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url